ঠাকুর বাড়ির ধূলি


১৯৯৩ সাল, শাহজাদপুর শহরে আমি নবাগত। ক্লাস ফাইভে সদ্য ভর্তি হয়েছি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পাশেই মামার বাসা ছিল।
এর কিছুদিন পর গ্রাম থেকে আমার প্রাণপ্রিয়া নানী আসলেন আমাকে দেখতে। আমি যখন গ্রামে নানীর বাড়িতে থাকতাম তখন নানীর আঁচল ছিল আমার সব কিছু। সে যেখানে যেতো, আমিও তার আঁচল ধরে সেখানেই যেতাম। তো যাই হোক নানী এসেছেন আমাকে শাহজাদপুর শহর ঘুরে দেখতে। সবার প্রথমে তিনি আমাকে রবি ঠাকুরের কাচারী বাড়ি দেখবেন। তো আমি আর নানী রওনা হয়েছি, নানীর আঁচল ধরে হাটছি। নানী বলছিলেন, ''সেই অনেক আগের কথা, ঠাকুরেরা ছিল এই এলাকার জমিদার। একবার রবি ঠাকুর এর নৌকো আমার নানা বাড়ির ঘাটে ভিড়িয়ে ছিলো। আমার মা তখন ছোট্ট বালিকা। তিনি নিজ হাতে বকুল ফুলের মালা গেঁথে রবি ঠাকুরকে উপহার দিয়েছিলেন।'' 
তিনি আরো বলছিলেন, ''রবি ঠাকুর এই শাজাদপুরের মাটিতে বসে অনেক গান, কবিতা, গল্প রচনা করেছেন। যেমন, আমাদের ছোট নদী, তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, পোস্টমাস্টার, কীর্তি, ছুটি, সমাপ্তি, ইত্যাদি। রবি ঠাকুর আমাদের বিশ্ব কবি। আমাদের জাতীয় সংগীত তাঁর লেখা। সারা বিশ্ব চেনে তাঁকে এক নামে।''
শুনে গর্বে আমার চোখ ছলছল করতে লাগলো। 
নানীর সাথে রবি ঠাকুরের কাচারী বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম, নিজ হাতে লেখা বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির নমুনা, তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম। আরো দেখলাম তাঁর ব্যবহৃত পালঙ্ক, সোফা, আলনা, আয়না, আরাম কেদারা, খড়ম, হুঁকো, ফুলদানি, রান্নাঘরে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, লণ্ঠনসহ অনেক কিছু।'' 
এরপর নানী বললেন, ''রবি ঠাকুর আজ নেই, কিন্তু তার পায়ের ধূলো ঠিকই রয়ে গেছে এই মাটিতে।'' বলেই তিনি কাচারী ঘরের মেঝে থেকে কিছু ধূলো আমার গায়ে-গালে-কপালে লেপন করে দিলেন আর বললেন, ''রবি ঠাকুরের মতন বড় মানুষ হইয়ো।''
কোনো ঈশ্বর আমাকে বর দেয়নি কোনো দিন, তবে আমার নানী আমাকে বর দিয়েছিলেন সেদিন। তাঁর হাতের ধুলো মাখা বর আমার প্রাণে প্রদীপ জ্বেলে ছিল।

এরপর ঠাকুরবাড়ির ধূলি গায়ে মেখে নানীর আঁচল ধরে হযরত শাহ মখদুম-এর মাজারের দিকে রওনা হলাম। 

Comments

Popular posts from this blog

The Best Apps for Creating Webcomics on Mobile

The Rise of Independent Animators on YouTube and TikTok

How Hayao Miyazaki Blends Cartoon and Cinematic Art